SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Social Account

আর কিছু নয়, গফরগাঁ থাইকা পীর সাহেবেরে নিয়া আস তোমরা । অনেক ভেবে চিন্তে বললেন রহিম সর্দার। তাই করেন হুজুর, তাই করেন! একবাক্যে সায় দিল চাষিরা। গফরগাঁ থেকে জবরদস্ত পীর মনোয়ার হাজিকেই নিয়ে আসবে ওরা। দেশজোড়া নাম মনোয়ার হাজির। অলৌকিক ক্ষমতা- সম্পন্ন ব্যক্তি তিনি । মুমূর্ষু রোগীকেও এক ফুঁয়ে ভালো করেছেন এমন দৃষ্টান্তও আছে ৷
সেবার করিমগঞ্জে যখন ওলাবিবি এসে ঘরকে ঘর উজাড় করে দিচ্ছিল তখন এই মনোয়ার হাজি -ই রক্ষা করেছিলেন গাঁটাকে। সাধ্য কি ওলাবিবির মনোয়ার হাজির ফুঁয়ের সামনে দাঁড়ায় । দিন দুয়েকের মধ্যে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে গেল ওলাবিবি, দু'দশ গাঁ ছেড়ে। এমন ক্ষমতা রাখেন মনোয়ার হাজি ।
গাঁয়ের লোক খুশি হয়ে অজস্র টাকা পয়সা আর অজস্র জিনিসপত্র ভেট দিয়েছিল তাঁকে। কেউ দিয়েছিল বাগানের শাক-সবজি। কেউ দিয়েছিল পুকুরের মাছ। কেউ মোরগ হাঁস। আবার কেউ দিয়েছিল নগদ টাকা ।
দুধের গরুও নাকি কয়েকটা পেয়েছিলেন তিনি। এত ভেট পেয়েছিলেন যে, সেগুলো বাড়ি নিতে নাকি তিন তিনটি গরুর গাড়ি লেগেছিল তাঁর। সেই সৌভাগ্যবান পীর মনোয়ার হাজি! তাঁকেই আনবে বলে ঠিক করল গাঁয়ের মাতব্বরেরা, চাষি আর
ক্ষেত মজুররা । বললে, চাঁদা দিমু? কিসের লাইগা দিমু? ওই লোকডার পিছে ব্যয় করবার লাইগা?
মতি মাস্টারের কথায় দাঁতে জিভ কাটল জমির মুন্সি । তওবা, তওবা, কহেন কি মাস্টার সাব। খোদাভক্ত পীর, আল্লার ওলি মানুষ। দশ গাঁয়ে যারে মানে, তার নামে এত বড় কুৎসা! ভালা কাজ করলা না মাস্টার, ভালা কাজ করলা না। ঘন ঘন মাথা নাড়লেন জমির ব্যাপারী। পীরের বদ দোয়ায় ছাই অইয়া যাইবা! কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠল মতি মাস্টার। কি যে কও চাচা, তোমাগো কথা শুনলে হাসি পায়।
হাসি পাইবো না, লেখাপড়া শিখা তো এহন বড় মানুষ অইয়া গেছ। মুখ ভেংচিয়ে বললেন জমির
ব্যাপারী। চাঁদা দিলে দিবা না দিলে নাই, এত বাহাত্তরি কথা ক্যান?
কিন্তু, বাহাত্তরি কথা আরো একজনের কাছ থেকে শুনতে হলো তাদের। শোনালো দৌলত কাজির মেজ ছেলে রশিদ । শহরে থেকে কলেজে পড়ে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে বেড়াতে। চাঁদা তোলার ইতিবৃত্ত শুনে সে বলল, পাগল আর কি, পীর আইনা বন্যা রুখবো! এ একটা কথা অইলো?

কথা নয় হারামজাদা! জমির মুন্সি কোনো জবাব দেবার আগেই গর্জে উঠলেন দৌলত কাজি নিজে আল্লাহর ওলি, পীর দরবেশ; ইচ্ছা করলে সব কিছু করতে পারে। সব কিছু করতে পারে তাঁরা । এই বলে নূহ নবি আর মহাপ্লাবনের ইতিকথাটা ছেলেকে শুনিয়ে দিলেন তিনি ।
খবরটা রহিম সর্দারের কানে যেতে দেরি হলো না। দু-দশ গাঁয়ের মাতব্বর রহিম সর্দার। পঞ্চাশ বিঘে খাস আবাদি জমির মালিক। একবার রাগলে, সে রাগ সহজে পড়ে না তাঁর। জমির মুন্সির কাছ থেকে কথাটা শুনে রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন তিনি, এ্যা! খোদার পীরের ঠাট্টা তামাসা। আচ্ছা, মতি মাস্টারের মাস্টারি আমি দেইখা নিমু। দেইখা নিমু মইত্যা এ গেরামে কেমন কইরা থাহে। অত্যন্ত রেগে গেলেও একেবারে হুঁশ হারাননি রহিম সর্দার। কাজির ছেলে রশিদের নামটা অতি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন তিনি। কাজি বাড়ি কুটুম্ব বাড়ি, বেয়াই বেয়াই সম্পর্ক, তাই।
পীর সাহেবের নূরানি সুরত দেখে গাঁয়ে ছেলে-বুড়োরা অবাক হলো। আহা! এমন যার সুরত, গুণতার কত বড়ো, কে জানে! ভক্তি সহকারে পীর সাহেবের পায়ের ধুলো নিল সবাই। গরিব মানুষ হুজুর! মইরা গেলাম, বাঁচান। হুজুরের পা জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন জমির ব্যাপারী ।
জমির ব্যাপারী বোকা নন। বোঝেন সব। খোদার মন টলাতে হলে আগে পীর সাহেবের মন গলাতে হবে । পীর সাহেবের মন গললে এ হতভাগাদের জন্যে খোদার কাছে প্রার্থনা করবেন তিনি । তারপরেই না খোদা মুখ তুলে তাকাবেন ওদের দিকে ।
পীর সাহেব এসে পৌঁছলেন সকালে। আর ঘটা করে বৃষ্টি নামল বিকেলে।
বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি । সারাটা বিকেল বৃষ্টি হলো। সারা রাত চললো তার একটানা ঝপঝপ ঝনঝন শব্দ । সকালেও তার বিরাম নেই। প্রতি বছর এ সময়ে শ্রাবণ মাসের ‘ডাত্তর'। কেউ কেউ বলে বুড়ো বুড়ির ‘ডাত্তর’। এই ডাত্তরের আয়ুষ্কাল পনের দিন। এই পনের দিন একটানা ঝড় বৃষ্টি হবে। জোরে বাতাস বইবে। বাতাস যদি বেশি থাকে আর অমাবস্যা কি পূর্ণিমার জোয়ারের যদি নাগাল পায় তাহলে সর্বনাশ! নির্ঘাত বন্যা! ‘খোদা, রক্ষা কর! রক্ষা কর খোদা! রহম কর এই অধমগুলোর ওপর! কান্নায় ভেঙে পড়লেন জমির ব্যাপারী। মনে মনে মানত করলেন। যদি ফসল নষ্ট না হয় তাহলে হালের গরু জোড়া পীর সাহেবকে ভেট দেবেন তিনি। গম্ভীর পীর সাহেব ঢুলে ঢুলে তছবি পড়েন আর খোদার মহিমা বর্ণনা করেন সবার কাছে। খোদার মহিমা বর্ণনা শেষ হলে পীর সাহেবের মহিমা বর্ণনা প্রসঙ্গে অসংখ্য আজগুবি ঘটনার অবতারণা করেন তাঁর সাকরেদরা।
মনে আশা জাগে চাষিদের। আনন্দে চকচক করে ওঠে কোটরে ঢোকা চোখগুলো। ভিড়ের মাঝ থেকে গনি মোল্লা ফিসফিসিয়ে বললেন, কই নাই মনার পো? এই পীর যেই সেই পীর নয়, খোদার খাস পীর! যারা শুনেছে তারা মাথা নেড়ে সায় দিল, হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। আর যারা শোনেনি তারাও সেই মুহূর্তে বিশ্বাস করল কথাটা। পীর সাহেব সব পারেন। কিন্তু, থামাচ্ছেন না, প্রয়োজনবোধে থামাবেন তাই । কিন্তু, মতি মাস্টার বিশ্বাস করল না কথাটা। হেসে উড়িয়ে দিল। বললো, ঝড় থামাবে ওই বুড়োটি? মন্তর পড়ে ঝড় থামাবে?
হ্যাঁ, থামাবে। আলবত থামাবে। আকাশভেদী হুংকার ছাড়লেন গনি মোল্লা। চোখ রাঙিয়ে ফতোয়া দিলেন । এই নাফরমান বেদীনগুলো গাঁয়ে আছে দেইখাই তো গাঁয়ের এই দুরবস্থা।

হ্যাঁ, ঠিক কইছ মোল্লার পো। তাঁকে সমর্থন করলেন বুড়ো তিনজী মিঞা। এই কাফেরগুলোরে গাঁ থাইকা না তাড়াইলে গাঁয়ের শান্তি নাই ।
কিন্তু গাঁয়ের শান্তি রক্ষার চাইতে ‘ঢল’ রোখাটাই এখন বড় প্রশ্ন। প্রকৃতি উন্মাদ হয়ে পড়েছে । ক্ষুব্ধ বাতাস বারবার সাবধান করছে। ঢল হইব, ঢল। পানি ভরা চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনজী মিঞা। রক্ত দিয়ে বোনা সোনার ফসল।
হায়রে ফসল !
হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠেন তিনি, খোদা!
মসজিদে আজান পড়ছে। পীর সাহেব ডাকছেন সবাইকে। এস মিলাদ পড়তে এস। এস মঙ্গলের জন্য এস। টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে বৃষ্টির ভেতর ভিজে ভিজেই মসজিদের দিকে ছুট দিলেন জমির ব্যাপারী। যাবার সময় ঘরের বৌ-ঝিদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেলেন, এ রাত ঘুমাইবার রাত নয়। বুঝলা? অজু কইরা বইসা খোদারে ডাক ।
অজুটা সেরে উঠে দাঁড়াতেই কার একটা হাত এসে পড়ল ছকু মুন্সির কাঁধের ওপর। জমির মুন্সির ছেলে ছকু মুন্সি। গাঁট্টাগোট্টা জোয়ান মানুষ। প্রথমটায় ভয়ে আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, কে? ভয় নাই আমি মতি মাস্টার।
ব্যাপার কি? এ রাত্তির বেলা? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে ছকু । মতি মাস্টার বললো, যাও কনহানে?
যাই মসজিদে । ছকু জবাব দিল । ক্যান তোমরা যাইবা না?
না। স্বল্প থেমে মতি মাস্টার বললো। এক কাজ কর ছকু। মসজিদে যাওয়া এহন রাখ। ঘর থাইকা কোদাল নিয়া বাইর অইয়া আয়। যা জলদি কর। কোদাল দিয়া কি অইবো? রীতিমতো ঘাবড়ে গেল ছকু মুন্সি। যা ছকা । কোদাল আন । পেছন থেকে বললো মন্তু শেখ
এতক্ষণে পুরো দলটার দিকে চোখ পড়লো ছকু মুন্সির। একজন দুজন নয়, অনেক। অন্তত জন পঞ্চাশেক হবে। সবার হাতে কোদাল আর ঝুড়ি ।
মতি মাস্টার এত লোক জোটাল কেমন করে ? কাজি বাড়ির পড়ুয়া ছেলে রশিদকে দলের মধ্যে দেখে
আরো একটু অবাক হলো ছকু ।
ব্যাপারটা অনেক দূর আঁচ করতে পারল সে। গতকাল এ নিয়েই কাজি পাড়ায় বুড়ো কাজির সঙ্গে তর্ক করছিল মতি মাস্টার। গত কয়েক বছর কি খোদারে ডাকেন নাই আপনারা? হ্যাঁ, ডাকছিলেন । কিন্তু ফল কি হয়েছে ? ফসল কি বাঁচছে আপনাগো? বাঁচে নাই। তাই কইতে আছলাম কেবল বইসা বইসা খোদারে ডাকলে চলবো না। এ কয়টা গাঁয়ে মানুষ তো আমরা কম নই। সবাই মিলে বাঁধটারে যদি পাহারা দিই, সাধ্য কি বাঁধ ভাঙে?
মতি মাস্টারের কথা শুনে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে এসেছিলেন বুড়ো কাজি। অশ্রাব্য গালি-গালাজ করেছিলেন তাকে। সে কাল বিকেলের কথা। মসজিদে আজান হচ্ছে। পীর সাহেব ডাকছেন সবাইকে, এস মিলাদ পড়তে এস। এস মঙ্গলের জন্য এস।
সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ছকু। তারপর টুপিটাকে মাথায় চড়িয়ে মসজিদের দিকে পা বাড়ালো সে। খপ করে একখানা হাত চেপে ধরলে রশিদ, ছকু।

এই ছকা । ক্ষেপে উঠলো পণ্ডিত বাড়ির চাঁদু । অগত্যা, কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে এল ছকু মুন্সি ।
মাইল খানেক হাঁটতে হবে ওদের। তারপর বাঁধ ।
নবীন কবিরাজের পুকুর-পাড়ে এসে পৌঁছতেই জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল একটা । ভয়ে আঁতকে উঠে থমকে দাঁড়াল ছকু । খোদা সাবধান করছে তাদের। খবরদার যাইও না। যাইও না মাস্টার । থামো, থামো! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ছকু মুন্সি। খোদা নারাজ হইবো, মসজিদে চল সবাই ।
ইস, চুপ কর ছকু । বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে মতি মাস্টার। এখন কথা কইবার সময় না । জলদি চল । আবার চলতে শুরু করল ওরা।
দূরে মসজিদ থেকে দরুদের শব্দ ভেসে আসছে। পীর সাহেবের সঙ্গে গলা মিলিয়ে দরুদ পড়ছে তিনজী মিঞা, জমির ব্যাপারী, রহিম সর্দার ও আরো কয়েকশ জোয়ান জোয়ান মানুষ। অসহায়ের মত ঊর্ধ্বে হাত তুলে চিৎকার করছে তারা। হে আসমান জমিনের মালিক! হে রহমানের রহিম! তুমিই সব! তুমি রক্ষা কর আমাদের!
ওদিকে মরিয়া হয়ে কোদাল চালাচ্ছে মতি মাস্টারের দল । এ বাঁধ ভাঙতে দেবে না তারা। কিছুতেই না। তাদের সোনার ফসল ডুবতে দেবে না তারা কিছুতেই । কখনই না ।
ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ আকশে বিদ্যুৎ চমকিয়ে বাজ পড়ছে। সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস বইছে। খরস্রোতা নদী ফুলে
ফেঁপে ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। অমাবস্যার জোয়ার। নির্ঘাত বাঁধ ভেঙে পড়বে।
হায় খোদা! ঘরের বৌ-ঝিয়েরা করুণ আর্তনাদ করে ফরিয়াদ জানায় আকাশের দিকে চেয়ে। দুনিয়াতে ইমান বলে কিছু নেই, তাই, খোদা রাগ করেছেন। মানুষ গরু সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন তিনি । ধ্বংস করে দেবেন এই পৃথিবীটাকে, পাপে ভরা এই পৃথিবী ।
দুরু দুরু বুক কাঁপছে তিনজী মিঞার। চোখের জলে ভাসছেন জমির ব্যাপারী। আর ঢুলে ঢুলে তছবি পড়ছেন ।
হায়রে ফসল!
সোনার ফসল!
এ ফসল নষ্ট হতে পারে না । টর্চ হাতে ছুটোছুটি করছে মতি মাস্টার । কোদাল চালাও! আরো জোরে !
বাঁধে ফাটল ধরেছে। এ ফাটল বন্ধ করতেই হবে।
অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে কোদাল চালাচ্ছে ওরা।
মন্ত্র শেখ চিৎকার করে বললে, আলির নাম নাও ভাইয়া, আলির নাম নাও ।
আলির নামে কাম হইবো শেখের পো ? বললে বুড়ো কেরামত। তারছে একডা গান গাও। গায়ে জোস আইবো ।
মন্তু শেখ গান ধরলো।

গানের শব্দ ছাপিয়ে হঠাৎ বাজ পড়লো একটা কাছে কোথায়। কোদাল চালাতে চালাতে মতি মাস্টারকে আর তার চৌদ্দ পুরুষকে মনে মনে গাল দিতে লাগলো ছকু মুন্সি, খোদার সঙ্গে লাঠালাঠি। হা-খোদা, এই কি জমানা আইছে। খোদা, এই অধমের কোনো দোষ নাই । এই অধমেরে মাপ কইরা দিও । ঝুড়ি মাথায় বিড়বিড় করে উঠলো পণ্ডিত বাড়ির চাঁদু, হাত-পা গুটাইয়া মসজিদে বইসা বইসা ঢল রুখবো না আমার মাথা রুখবো। তারপর হঠাৎ এক সময়ে মতি মাস্টারের গলার শব্দ শোনা গেল, আর ভয় নাই চাঁদু । আর ভয় নাই। এবার তোরা একটু জিরাইয়া নে! এতক্ষণে হাসি ফুটলো সবার মুখে। শ্রান্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বাঁধের ওপর এলিয়ে পড়লো অবশ দেহগুলো । পঞ্চাশটি ক্লান্ত মানুষ । সূর্য তখন পুব আকাশে উঁকি মারছে।
আধো আলো অন্ধকার আকাশ বেয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মৃদুমন্দ বাতাসের তালে তালে নাচছে সোনালি ফসল। মসজিদ থেকে বেরিয়ে হঠাৎ সেদিকে চোখ পড়তে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো জমির বেপারী। ডোবেনি। ডুবতে দেননি পীর সাহেব ।
খুশিতে চক্‌চক্ করে উঠলো জমির মুন্সির চোখ দুটো। দৌড়ে এসে পীর সাহেবের পায়ে চুমু খেলেন গনি মোল্লা । ডোবেনি ডোবেনি। ফসল তাদের ডোবেনি। ডুবতে দেননি পীর সাহেব ।
এক মুহূর্তে যেন চাঙ্গা হয়ে উঠেছে সমস্ত গাঁ-টা। ছেলে বুড়ো সবাই হুমড়ি খেয়ে ধেয়ে আসছে পীর
সাহেবের পায়ে চুমু খাবার জন্যে। ঘুম চোখে তখনও ঢুলছেন পীর সাহেব। স্বল্প হেসে বললেন, খোদার
কুদরতের শান কে বলতে পারে ।
সাকরেদরা সমস্বরে বলে উঠলো, সারারাত না ঘুমাইয়া খোদারে ডাকছেন আমাগো পীর সাব। বাঁধ ভাঙ্গে সাধ্য কি?
পীর সাহেব তখনো হাসছেন। স্বল্প পরিমিত হাসি আপেলের রক্তিমাভার মতো ফেটে ছড়িয়ে পড়ছে মুখের সর্বত্র।

Content added By

জহির রায়হান ১৯৩৫ সালের ১৯শে আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর আসল নাম মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। একজন ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে জহির রায়হান খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি মূলত মধ্যবিত্ত জীবনের রূপকার। চারপাশের মানুষের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার চিত্র তাঁর রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে। সমাজের নানা বৈষম্য ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধেও তাঁর কণ্ঠ ছিল বলিষ্ঠ । হাজার বছর ধরে, বরফ গলা নদী, শেষ বিকেলের মেয়ে, আরেক ফাল্গুন ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার হিসেবেও জহির রায়হানের পরিচিতি রয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় লাভের অল্পকাল পরেই ১৯৭২ সালের ৩০শে জানুয়ারি তিনি নিখোঁজ ও শহিদ হন। তাঁর লাশ পাওয়া যায়নি।

Content added By

ওলাবিবি- প্রাচীন সমাজে পূজ্য কলেরা রোগের দেবী। তল্পিতল্পা - বিছানাপত্র বা অন্যান্য জিনিসপত্রের বোঁচকা। ভেংচি— উপহাসসূচক বিকৃত মুখভঙ্গি।

বাহাত্তর কথা- বাহাত্তর বছর বয়স্ক শক্তিহীন অকেজো বৃদ্ধের সংলাপ, বাজে কথা । সাকরেদ- শাগরেদ, চেলা, সহকারী । নাফরমান— অবাধ্য, আদেশ অমান্যকারী।

কাফের- সত্য প্রত্যাখ্যানকারী, ইসলাম-বিরোধী লোক ।

Content added By

নেতৃত্ব, একতা এবং কর্মস্পৃহা সকল প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করতে পারে- জহির রায়হানের ‘বাঁধ’গল্পে সে কাহিনিই বিবৃত হয়েছে । গ্রামের একশ্রেণির মানুষ প্রচণ্ড রকমের দৈববিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করতে চেয়েছে। বর্ষার ঢল থেকে গ্রাম ও ফসলরক্ষাকারী বাঁধ রক্ষার জন্য জমির মুন্সির নেতৃত্বে তারা পীরের শরণাপন্ন হয়। পক্ষান্তরে মতি মাস্টারের নেতৃত্বে গ্রামের অপর একটি শ্রেণি ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে মাটি কেটে বাঁধকে সংহত ও মজবুত করে। এভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে গ্রামের মানুষ তাদের কষ্টের ও স্বপ্নের ফসল রক্ষা করে। অন্ধবিশ্বাস নয়, যুক্তি, বুদ্ধি ও কৌশল দিয়েই মূলত প্রাকৃতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে হয়। ‘বাঁধ' গল্পটি আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।

Content added By